রোনালদো ও রিভালদো এর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ গাঁথা ২০০২

২০২২ বিশ্বকাপ , ২০০২ এর পর আসর আবার এশিয়ায়। কিন্তু এবার এই বিশ্বকাপ হবে কার? এশিয়াতে হওয়া এর আগের বিশ্বকাপের বিজেতা কে জানেন তো? ৫ম বারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া দক্ষিণ আমেরিকার দল ব্রাজিল।

২০০২ সাল। বিশ্বকাপটা এশিয়ার জাপান আর সাউথ কোরিয়ায়। সে আসরে ৩২ দলের মধ্যে এশিয়ার ৪ দল, আফ্রিকার ৫ দল, উত্তর আমেরিকার ৩ দল, দক্ষিণ আমেরিকার ৫ দল এবং ইউরোপ থেকে ১৫ দল বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার সুযোগ পায়। 

আজ শুনব, ব্রাজিলের ৫ম বারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প।  ব্রাজিলের তখনকার সময়ের কোচ ছিলেন লুই ফেলিপে স্কলারিও। ব্রাজিলের এই সফলতার জন্য অনেকেই মনে করেন এই কোচ প্রশংসার দাবি রাখেন। তখনকার ব্রাজিল দলে স্কোয়াডে ছিলেন লুসিও, এডমিলসন, রক জুনিয়র, গিলবার্তো সিল্ভা, মার্কোস, কাকা, ভেম্পেটা, এন্ডারসন পলগা, দিদা, রোজেরিও সেনি, জুলিয়ানো বেলেত্তি, রোনালদিনহো, রোনালদো, রবার্তো কার্লোস, কিলবার্সন, রিভালদো, কাফু(অধিনায়ক), জুনিয়র, রিকার্ডিনো, লুইজাও, এডিলসন, ডেনিলসন এবং জুনিনহো। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের গ্রুপ ছিল C, সেই গ্রুপে ছিল ইউরোপের দল তুর্কি, উত্তর আমেরিকার ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দল কোস্টারিকা এবং এশিয়ার চীন। 

৩রা জুন ২০০২ঃ ব্রাজিল বনাম তুর্কি (গ্রুপ পর্ব)

ব্রাজিলের প্রথম খেলাটি পড়ে তুর্কি এর সাথে। এই গ্রুপে তুর্কিই ছিল ব্রাজিলের সাথে টেক্কা দেওয়ার মত দল। উলসানের মুন্সু কাপ স্টেডিয়ামে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই ব্রাজিল হোঁচট খায় শুরুর দিকে। শুরু থেকেই তুর্কি প্রায় অনেক আক্রমণ চালায় এবং প্রথমার্ধ্বের অতিরিক্ত ২ মিনিটের সময় তুর্কির লেফট উইঙ্গার হাসান ব্রাজিলের জালে প্রথম গোলটি দেয়। তবে ঠিক তাঁর ৩ মিনিট আগে তুর্কির সেন্ট্রাল ব্যাক আল্পে ওজালান ফাউল করার কারণে হলুদ কার্ড খায়। দ্বিতীয় অর্ধ্বে ব্রাজিল সম্পূর্ণ রূপ পরিবর্তন করে তাঁদের আক্রমণের ধার বাড়ায় এবং ফলস্বরুপ ৫০ মিনিটে রিভালদো এর পাস থেকে ব্রাজিলের স্ট্রাইকার রোনালদো ব্রাজিলের পক্ষে প্রথম গোলটি করে। পুরো দ্বিতীয়ার্ধ্বে ব্রাজিল তুর্কিকে দাঁড়াতেই দেয় নি, এদিকে তুর্কি একের পর এক ফাউল করতে থাকে , ৮৬ মিনিটের মাথায় ডিবক্সের মধ্যে রিভালদোকে ফাউল করার কারণে তুর্কির সেন্ট্রাল ব্যাক আল্পে ওজালানকে রেফারি লাল কার্ড দেখায় এবং ব্রাজিলের পক্ষে পেনাল্টি কিক নেয় রিভালদো। তখনকার সময়ে এই পেনাল্টি কিক নিয়ে অনেক আর্জেন্টাইন সমর্থকরা বিতর্ক করে। ৯৪ মিনিটে গিয়ে তুর্কির এটাকিং মিডফিল্ডার বাসতুর্ক দ্বিতীয় হলুদ কার্ড খেলে তুর্কি ৯ জন নিয়ে তাঁদের প্রথম ম্যাচ শেষ করে এবং ব্রাজিল ২-১ ব্যবধানে জয়লাভ করে। রিভালদো ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন।

 ৮ জুন ২০0২ঃ ব্রাজিল বনাম চীন (গ্রুপ পর্ব)

এই ম্যাচে এক হালি গোল দিয়ে ব্রাজিল চীনের সাথে জয়লাভ করে। ব্রাজিলের পক্ষে গোল করেন রবার্তো কার্লোস, রিভালদো, রোনালদিনহো এবং রোনালদো। সর্বপ্রথম ম্যাচের ১৫ মিনিটে অসাধারণ এক ফ্রি কিক থেকে গোল করেন কার্লোস, এরপর ৩২ মিনিটে রোনালদিনহো এর পাস থেকে রিভালদো ২য় গোল করেন, ৩য় গোলটি হয় ৪৫ মিনিটে পেনাল্টি(গোলদাতা-রোনালদিনহো) থেকে এবং শেষ গোলটি করেন রোনালদো। ম্যাচসেরা হল রবার্তো কার্লোস।

১৩ জুন ২০০২ঃ কোস্টারিকা বনাম ব্রাজিল (গ্রুপ পর্ব)

রোনালদো ১০ এবং ১৩ মিনিটে জোড়া গোল করার পর ৩৮ মিনিটে এডমিলসন ৩য় গলটি করলে অনেকটা ব্রাজিলীর জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর কোস্টারিকা ৩৯ ও ৫৬ মিনিটে জোড়া গোল করে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করলেও রিভালদো এবং জেনিলসন জুনিয়র ৬২ ও ৬৪ মিনিটে আরো ২ টি গোল করে গোলবন্যায় ভাসায় কোস্টারিকাকে। অবশেষে ব্রাজিল ৫-২ ব্যবধানে জয়লাভ করে। ম্যাচসেরা হন জেনিলসন জুনিয়র।

১৭ জুন ২০০২ঃ ব্রাজিল বনাম বেলজিয়াম (রাউন্ড ১৬)

ইউরোপের ডার্কহর্স খ্যাত বেলজিয়াম শুরু থেকে ভালো খেললেও গোলের দেখা পায় নি। ৬৭ মিনিটে ব্রাজিলের রিভালদো এবং ৮৭ মিনিটে রোনালদো গোল করে ২-০ ব্যবধানের জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়। ম্যাচসেরা হন রিভালদো।

২১ শে জুন ২০০২ঃ ইংল্যান্ড বনাম ব্রাজিল (কোয়ার্টার ফাইনাল)

এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মুখোমুখি হওয়া দলগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল এই ইংল্যান্ড। মাইকেল ওয়েন ২৩ মিনিটে গল করে ইংল্যান্ডকে ১-০ তে এগিয়ে নিলে অনেকেই ভাবতে শুরু করে ব্রাজিলের হয়ত এই ম্যাচই শেষ ম্যাচ এই বিশ্বকাপে। কিন্তু ব্রাজিলের খেলা যে এতোটা অনন্য ছিল এই ম্যাচে যা যুগ যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রথমার্ধ্বের অতিরিক্ত সময়ের ২ মিনিটে ব্রাজিলের অতর্কিত আক্রমণে রোনালদিনহো এর পাস থেকে রিভালদো এর করা গোল ১-১ এ সমতায় ফিরতে সাহায্য করে ব্রাজিলকে। ২য় অর্ধ্বের শুরুর দিকে ৫০ মিনিটে অসাধারণ এক ফ্রি কিক থেকে গোল করেন রোনালদিনহো। ঐ বিশ্বকাপের অন্যতম গোলকিপার এটা বুঝতেই পারেন নি যে গোল হবে। পরবর্তীতে আর কোন গোল না হওয়ায় ব্রাজিল ২-১ এ জিতে সেমিফাইনালে উন্নীত হয়। রিভালদো অসাধারণ আক্রমণের জন্য আবারো ম্যাচসেরা নির্বাচিত হন।

২৬ শে জুন ২০০২ঃ ব্রাজিল বনাম তুর্কি (সেমিফাইনাল)

একেই ট্যুর্ণামেন্টে ২য় বারের মত আবার তুর্কির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। এবার তুর্কি গ্রুপ পর্বের ভুলগুলো শুধরে নেয়। কিন্তু ৪৯ মিনিটে রোনালদো এর করা ১ মাত্র গোলের লিডে ব্রাজিল ১-০ তে জয় নিয়ে ৭ম বারের মত ফাইনালে উন্নীত হয়। 

৩০ শে জুন ২০০২ঃ জার্মানী বনাম ব্রাজিল (ফাইনাল)

এই বিশ্বকাপে সবাই প্রথম থেকে ধরেই নিয়েছিল জার্মানী এবার বিশ্বকাপ নিবে এবং ওরা পুরা ট্যুর্ণামেন্টে যে মানের খেলা খেলছিল তাতে ভাবনাটাকে সত্যি বলেই মনে হচ্ছিল। প্রচণ্ড গতিতে খেলা জার্মানী দল ফাইনালে পৌঁছার পর এ ভাবনা আরো জোরালো হয় জার্মানী জিতবে এবার। শুরু থেকে আক্রমণের পর আক্রমণ করতে থাকে জার্মানী, অসাধারণ ফুটবল খেলে তাঁরা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যাকে বলে আর কি। গোলের খেলা ফুটবলে গোল না হলে সবাই ভাগ্যকেই দোষারোপ করে আসলে তাই হয়েছিল জার্মানী এর সাথে। কিন্তু ব্রাজিল যেভাবে জার্মানীর আক্রমণভাগকে সামলে নিজেরা আক্রমণে গিয়েছে তাও যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। ৬৭ মিনিটে  ডি বক্সের বাইরে থাকা রিভালদো এর এক আচমকা শট অনেকটা অপ্রস্তুত করে ফেলে জার্মানীর গোলকিপার অলিভার কান কে প্রথম ধাক্কায় গোল সামলালেও বল সামলাতে পারেন নি এই ট্যুর্ণামেন্টের গোল্ডেন বল বিজয়ী অলিভার কান। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে ভুলেন নি রোনালদো, সুযোগ পাওয়া মাত্রই গোলটি করেন। এক গোল খাওয়ার ম্যাচে ফিরতে মরিয়া জার্মানী একের পর এক আক্রমণ করেই যাচ্ছিল। কিন্তু সফলতা পায় নি। ২য় অর্ধ্বে ব্রাজিল অনেক ভালো খেলেছিল ১ম অর্ধ্বের তুলনায় , ৭৯ মিনিটে রোনালদো এর করা আরেক গোলে ব্রাজিল ২-০ গোলে জিতে তাঁদের ৫ম শিরোপা ঘরে তুলে আর পুরো বিশ্বে ব্রাজিলিয়ান সাপোর্টারদের আবেগ আপ্লুত করে।

সেমিফাইনাল ও ফাইনাল দুই খেলায় ম্যাচসেরা নির্বাচিত হয় ব্রাজিলের রোনালদো এবং এই আসরে তিনি গোল্ডেন বুট বিজয়ী হন।

যেসব কারণে ব্রাজিলের সফলতাঃ

এই বিশ্বকাপে যেসব কারণে ব্রাজিল জিতেছিল তাঁর মধ্যে অন্যতম হল রোনালদো এবং রিভালদো এর অসাধারণ কম্বিনেশন। রোনালদো সাধারণত খুব কম গোলই মিস করতেন আর পায়ে বল আসার সাথে সাথে খুব দ্রুত শট নিতে পারতেন। এদিকে রিভালদো উনার অনেক বয়স হলেও সেইসময় ছিলেন দারুণ ফর্মে। উনি লং শট ভালো নিতে আর খুব দ্রুত দৌড়াতে পারতেন। এই জুটি এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই তাঁদের পারফেকশনের পরিচয় দিয়ে এসেছেন। তবে রোনালদিনহো, ফ্রি কিক স্পেশালিস্ট রবার্তো কার্লোস এমনকি ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্স তাঁদের অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। আর এইসবের সম্মিলিত ফল হল তাঁদের পেন্টা মিশনের সফলতা। 

২০ বছর কেটে গেছে ২০০২ এর পর, এবার কি পারবে ব্রাজিল হেক্সা মিশনে সফল হতে?

Share

One thought on “রোনালদো ও রিভালদো এর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ গাঁথা ২০০২

  1. I would like to thnkx for the efforts you have put in writing this blog. I am hoping the same high-grade blog post from you in the upcoming as well. In fact your creative writing abilities has inspired me to get my own blog now. Really the blogging is spreading its wings quickly. Your write up is a good example of it.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Proudly powered by WordPress | Theme: Lean Blog by Crimson Themes.