জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন মানুষ তাঁর অতীতের হাসিখুশি সময়ে ফেরত যেতে যায় সফলতার সেই দিনগুলোর মতো করেই বাকিটা জীবন বাঁচতে চায়। হারানো দিন ফিরে পাবার এই আকাঙ্ক্ষাকে nostalgia বলে। রোনালদিনহো এখন হয়ত সেই দিনগুলোতে আবারো ফেরত যেতে চান যেখানে লাখ লাখ দর্শক মাঠে তাঁর নাম একসাথে উচ্চারণ করছে, সেই খ্যাতি সেই আনন্দের দিনগুলো নিয়েই বেঁচে থাকতে চান।
১৯৮৫ঃ
চলুন ঘুরে আসা যাক রোনালদিনহো এর ছোটবেলায়। ব্রাজিলের porto alegre শহরে তাঁর বেড়ে উঠা। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি তাঁর আসক্তি ছিল, এর বড় কারণ হল তাঁর বাবা এবং বড় ভাই ফুটবল খেলতেন আর ছোট থেকেই নিজে নিজেই অনেক টেকনিক চেষ্টা করতেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা যেটা অন্য বাচ্চাদের চেয়ে তাঁকে ভিন্নভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় তখনকার স্থানীয় কোচদের কাছে। উনার মা একজন ধোপানি ছিলেন এবং বাবা ২ টা চাকুরি করতেন। অনেক দরিদ্র ঘরে জন্ম এই তারকার কিন্তু তাঁর মা বাবা বিশ্বাস করতেন এবং সন্তানদের বিশ্বাস করাতেন যে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো সম্ভব। পরিবারে সবার ছোট বলে তিনি সবার কাছ থেকে সমসময় আদর পেতেন। তাঁর বোন, ২ ভাই , মা বাবা সবাই অনেক ভালোবাসতেন।
১৯৮৮ঃ
রোনালদিনহো এর বাবা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ক্লাব Gremio এর সাপোর্টার ছিলেন তাই রোনালদিনহো এর ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল এই ক্লাবের হয়ে খেলা। সাত বছর বয়সে তিনি ঐ ক্লাবের একাডেমিতে যোগ দেন। ঐ সময় তাঁর বড় ভাই রবার্তো এই ক্লাবে খেলতেন। ১৬ বছর বয়সে তাঁর বড় ভাই প্রফেশনাল ফুটবলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এরপর থেকে তাঁদের পরিবারের দরিদ্র অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। তাঁর বড় ভাই সংসারের হাল ধরেন। ১৭ বছর বয়সে তাঁর বড় ভাই একজন বড় ব্রাজিলিয়ান ফুটবল তারকা হয়ে উঠেন দেশেই। তাঁর বড় ভাইয়ের জন্মদিন উদযাপনের দিন তাঁর বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করেন। ফুটবলের প্রতি রোনালদিনহো এর মধ্যে আগ্রহের যে বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা সেটাকেই সযত্নে বড় করেছেন নিজে এবং সফলতাও পেয়েছেন এই ফুটবল তারকা। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই লাপোর্তা তাঁকে বাবার স্নেহে বড় করেছেন, সুখ-দুঃখে-বিপদে পাশে থেকেছেন। পরবর্তী জীবনে এই ফুটবলার তাঁর ভাইকেই আইডল মেনেছেন। রবার্তো নী ইনজুরিতে পড়ে প্রায় ৮ মাসের মতো খেলা থেকে বাইরে থাকলে তা পরবর্তীতে তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনকে বেশিদূর এগোতে দেয় নি। রোনালদিনহো এর ছোটবেলার কোচ Augusto Bendira বলেন ছোট থেকেই ওর মধ্যে যে ফুটবল প্রতিভা ছিল তা অসাধারণ।
১৯৯৪ঃ
১৪ বছর বয়সে ব্রাজিলিয়ান তারকা দেখেছিলেন সেই বুনো উল্লাস ব্রাজিলের মানুষদের ভালোবাসা যে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান দল- তখনই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যেন এইভাবে বিশ্বকাপ জয় করে একদিন দেশে আসতে পারেন।
১৯৯৯-২০০১ঃ
১৭ বছর বয়সে Gremio এর হয়ে প্রায় সব ম্যাচেই অসাধারণ খেলতে থাকেন রোনালদিনহো। যার কারণে ১৯ বছর বয়সে তিনি ডাক পান ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল দলে এবং এখানেও অসাধারন খেলতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই সকল ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর প্রতি আগ্রহ ছিল উনার এবং অফার পেলে পি এস জি তে যোগদান করার সিধান্ত নেন। এর রেশ ধরে Gremio এর সমর্থকেরা সাংবাদিকেরা রোনালদিনহো কে বলতে থাকে যে তিনি টাকা ছাড়া কিছু চিনেন না, টাকার জন্য খেলেন, এমনকি তিনি একা কোথাও যেতে পারতেন না, Gremio এর সাপোর্টাররা অনেক বেশি রেগে ছিল, রাতারাতি ভালোবাসার এই তারকা ওদের চোখে পরিণত হলেন খলনায়কে। দুঃখজনক হল এসব মানুষ রোনালদিনহো এর মাকে ও বাদ দেয় নি, অকথ্য ভাষায় গালি দিয়েছে। যে ক্লাবে উনার পুরো পরিবার খেলেছে সেই ক্লাব তাঁর জন্য পরিবারের চেয়ে কম ছিল না , রোনালদিনহো খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন মানুষের এই ধরণের আচরণে।
২০০২ঃ
বিশ্বকাপ এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে। ফুটবল তারকায় ভরা ব্রাজিলিয়ান দলে রোনালদিনহো ছিলেন উঠতি খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন। নিজের প্রথম(২২ বছর বয়সে) বিশ্বকাপে এসে অসাধারণ খেলেছেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা এবং বিশ্বকাপজয়ী দলের গর্বিত সদস্য ছিলেন। তিনি ৩ এসিস্ট এবং ২ গোল করেছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপে। প্রায় ৩০ ইয়ার্ড বাইরে থেকে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ফ্রি কিক থেকে উনি যে গোল করেছিলেন তা রীতিমত অবাক করার মত ছিল।
২০০৩ঃ
জোয়ান লাপোর্তা ২০০৩ এ বার্সেলোনা এর প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব নেওয়ার আগে বার্সা খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। বলতে গেলে প্রায় ৪ বছরের ও বেশি সময় ধরে বার্সা কোন ট্যুর্ণামেন্ট জিততে পারছিল না। সে সময়ে জোয়ান গাসপার্ট ছিলেন বার্সার প্রেসিডেন্ট। বার্সা নিজেদের ঘরের মাঠে SEVILLA এর কাছে ০-৩ এ হারার পর সেইসময়কার কোচ প্রেসিডেন্ট এর পদত্যাগ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, বার্সার সমর্থকেরা বিক্ষোভে অনেক ভাংচুর করে মাঠে, পুর শহর জুড়ে বিক্ষোভ হয়।
এসব কিছুর জেরে গাসপার্ট ও কোচ লুই ভন গাল পদত্যাগ করে এবং লাপোর্তা ১৫ ই জুন ২০০৩ সালে হিসেবে বার্সার দায়িত্ব নেন। বার্সার ফ্যানরাই লাপোর্তাকে পরিবর্তনের আশা নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। লাপোর্তা এবং তাঁর ম্যানেজম্যান্ট দল প্রথম থেকেই এমন একজন খেলোয়াড়ের খোঁজ করতে থাকে যিনি দলের momentum কে পরিবর্তন করতে পারে জয়ের ধারায় ফেরাতে পারে। লাপোর্তা বলেন, রোনালদিনহো ঐ সময়ের সেরা একজন খেলোয়াড় ছিলেন, একজন দক্ষ ফুটবলার , একজন শিল্পী যার কাছেই ফুটবলই ছিল সবকিছু, ফুটবলই ছিল ভালোবাসা। ২০০২ এ যখন রোনালদিনহো বিশ্বকাপ জয় করেন তখন তিনি ফ্রান্সের পিএসজি তে খেলছিলেন। তখনকার পিএসজি কোচ লুই ফার্নান্দেজ রোনালদিনহো এর সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করতেন এবং কিছু উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিতেন যা রোনালদিনহো এমনকি দর্শকদের ও পছন্দ হত না। কোচ ভাবত সবারই ডিফেন্ড করতে জানা জরুরী কিন্তু রোনালদিনহো সবসময় এটাকিং খেলোয়াড় হিসেবেই খেলতে অভ্যস্ত ছিল। লাপোর্তার এক নাম্বার পছন্দে ছিল রোনালদিনহো, তাই তাঁরা চেষ্টা করতে থাকল যেন রোনালদিনহো কে বার্সা তে আনা যায়। রোনালদিনহো এর ভাই ফুটবলার রবার্তো একটি হোটেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং বার্সেলোনার ম্যানেজম্যান্টের সাথে দেখা করে। রোনালদিনহো এর সামনে এমন দুইটা ক্লাব ছিল যেখানে একটা ক্লাব(ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) সফলতার প্রায় শীর্ষ পর্যায়ে ছিল আর অপরদিকে বার্সা ছিল ডুবতে থাকা একটি তরীর মতো। এক পর্যায়ে অন্তত এটা নিশ্চিত হওয়া গেল রোনালদিনহো হয়ত বার্সার হয়ে খেলছেন না। শেষবারের মতো বার্সার ম্যানেজম্যান্ট রোনালদিনহো কে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন এবং ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুই ফেলিপে স্কলারি এর স্মরণাপন্ন হন এবং তাঁকে অনুরোধ করেন যেন তিনি রোনালদিনহো কে বুঝান বার্সায় যোগ দিতে। স্ক্লারি জানতেন রোনালদিনহো ঐ সময় আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিলেন, এটি প্রধান কারণ ছিল পিএসজি এর কোচ, স্কলারি এটাও জানতেন রোনালদিনহো এর দরকার ছিল এমন পরিবেশ যেখানে সে গেলে সম্মান পাবে এবং যে ক্লাব তাঁর খেলার উপর বিশ্বাস রাখবে। স্কলারি রোনালদিনহোকে বুঝাতে সমর্থ হয় এবং রোনালদিনহো বার্সায় যোগ দেয়। যেদিন কট্রাক্ট সাইনিং হবে সেইদিন বার্সার কোচ লাপোর্তা রোনালদিনহোকে বলেন, আমার কলমটি দিয়ে সাইন করো, আমি খুশি হব। রোনালদিনহো বার্সায় যোগদানের পর যে সম্মান ভালোবাসা পেয়েছিল এক কথায় অসাধারণ, সারা মাঠে শুধু এক সুর “রোনালদিনহো-রোনালদিনহো”। এর আগে বার্সার হয়ে ব্রাজিলের অন্যান্য খেলোয়াড় রোনালদো, রিভালদো, রোমারিও খেলেছেন এবং রোনালদিনহো এর কাছে এটা স্বপ্ন ছিল তিনিও একদিন এই ক্লাবে খেলবেন আর ওদের মতোই সুনাম অর্জন করবেন, কিন্তু বার্সার হয়ে খেলা তাঁর প্রথম ম্যাচের আগেই তিনি যে অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন তা অবিশ্বাস্য। নতুন দায়িত্ব নেওয়া কোচ ফ্রাঙ্ক রিজকার্ড খেলোয়াড়দের নিজের পরিবারের মতো দেখতেন এবং তাঁদের মানসিকতা বোঝার চেষ্ট করতেন এবং ঐ অনুযায়ী খেলোয়াড়দের পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। La Liga এর sevilla এর সাথে ম্যাচে অনেক আশা নিয়ে বার্সা রোনালদিনহো কে নিয়ে খেলতে নামে কিন্তু এতোদিনের পরাজয়ের হার থেকে বের হওয়া এতোটা সহজ ছিল না, পেনাল্টি থেকে গোল খেয়ে বসে বার্সা, এরপর মেজাজ হারিয়ে খেলোয়াড়রা বাদানুবাদে জড়ায়। কিছুক্ষণ পর খেলা আবার শুরু হয়। সবাই ভেবে নিয়েছিল হয়ত আবার ও হারবে বার্সা কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে রোনালদিনহো একক প্রচেষ্টায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিজের আয়ত্বে এনে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে অনেক দূর পর্যন্ত এগোয় এবং প্রায় ৩০ ইয়ার্ডেরও বেশি দূরে থেকে গোল করে। সেইদিন বার্সা জিততে না পারলেও বার্সার ফ্যানরা খুশি হয়েছিল রোনালদিনহো এর সেই অসাধারণ খেলা দেখে, সব সংবাদ মাধ্যমগুলো সেই গোলের ব্যাপারেই বলতে থাকে। এই সিজনের প্রথম অর্ধেক পথ বার্সার সম্পুর্ণ ভালো না গেলেও দলের মধ্যে স্পিরিট ধরে রেখেছিলেন এই বার্সা তারকা। এর মধ্যে রোনালদিনহো ইনজুরিতে পড়লে বার্সার টিম ম্যানেজম্যান্ট এবং সাপোর্টাদের মধ্যে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা দেয়। এদিকে এল ক্লাসিকোর ম্যাচে রিয়েল মাদ্রিদ এর বিপক্ষে রোনালদিনহো কে ছাড়ায় মাঠে নামতে হয়। বার্সা এবং রিয়েল মাদ্রিদের ম্যাচ মানেই উত্তাপ তাঁর কারণ হল সিভিল ওয়ারের সময় বার্সা সবসময় গণতন্ত্রের পক্ষে আর রিয়েল মাদ্রিদ ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে ছিল। ঐ ম্যাচে ক্যাম্প ন্যু তে রিয়েলের কাছে শোচনীয়ভাবে হারে বার্সা। কিছুদিন পর রোনালদিনহো ইনজুরি কাটিয়ে আবার দলে ফিরল। কোচ রোনালদিনহো কে বললেন তুমি তোমার মতো খেলো, এবং কোচের এই টেকনিকটা কাজে লাগে। রোনালদিনহো এতো বেশি শরীর মুভ করাতেন দৌড়ানোর সময় যা প্রতিপক্ষে খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত করত। পুরো বার্সা দলে শিশুসুলভ একটি অসাধারণ স্পিরিট নিয়ে এসেছিল এই তারকা যা পরবর্তী বছরগুলোতে ভালো ফল পেতে সাহায্য করেছিল। পরাজয়ের ভারে ডুবতে থাকা বার্সা পরপর ১৮ টি ম্যাচে অপরাজিত থাকে। এরই মধ্যে সময় আসে রোনালদিনহো তাঁর প্রথম এল ক্লাসিকো খেলার। এবার খেলা রিয়েলের বার্নাব্যুতে । প্রথম থেকেই বার্সা ডিফেন্স এবং এটাকে সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছে। এরপর ও মাদ্রিদ ১-০ তে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বার্সা ১-১ গোলে সমতায় ফিরে এবং শেষের দিকে রোনালদিনহোর অসাধারণ এসিস্টে বার্সা ১-২ এ মাদ্রিদের বিপক্ষে জিতে। প্রায় অনেক বছর পর মাদ্রিদকে হারাতে সমর্থ হয় বার্সা, হারানো বিশ্বাস আবারো ফিরে পায় । সেই ম্যাচেও জয়ের নায়ক ছিলেন এই তারকা।
শেষ পর্বটি পড়ুন- রোনালদিনহো-বিশ্বকাপজয়ী এক অসাধারণ ফুটবল তারকা – শেষ পর্ব